বাঁশবেড়িয়ার কুন্ডগলী নটরাজের ৭২ তম বর্ষের কার্তিক পূজা এ বছর যেন শুধু ধর্মীয় আচার নয়, এক সাংস্কৃতিক মহোৎসব

সৈকত দাস, বাঁশবেড়িয়া:

বাঁশবেড়িয়ার কুন্ডগলী নটরাজের ৭২ তম বর্ষের কার্তিক পূজা এ বছর যেন শুধু ধর্মীয় আচার নয়, এক সাংস্কৃতিক মহোৎসব। মণ্ডপের ভাবনা— ‘প্রবাহিনী’, যেখানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের পাঁচ হাজার বছরের ঐতিহ্যকে আধুনিক প্রেক্ষাপটে নতুন করে তুলে ধরা হয়েছে। পূজা প্রাঙ্গণে পা রেখেই দর্শনার্থীরা বুঝতে পারছেন যে এ বছরের উপস্থাপনা সাধারণ কোনো থিম নয়, বরং এক সুপরিকল্পিত, তথ্যসমৃদ্ধ ও দৃষ্টিনন্দন শিল্প-প্রকল্প।

নৃত্যকলার হাজার বছরের ভ্রমণ

মণ্ডপের বাইরের খোলনলচে থেকেই শুরু হয়েছে থিমের বক্তব্য। প্রবেশ পথের দুই পাশে শাস্ত্রীয় নৃত্যের বিখ্যাত মুদ্রা, পুরাণকথার চরিত্র, এবং ভরত মুনির ‘নাট্যশাস্ত্র’-এর উপাদান ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মনোরম ভাস্কর্য ও কাঠশিল্পে। ভেতরে ঢুকতেই দর্শনার্থীরা দেখতে পাচ্ছেন ভারতীয় নৃত্য রীতির বিবর্তনের এক বিরাট আখ্যান—সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ধারায় কীভাবে নৃত্যরূপ গড়ে উঠেছে, তা প্রতিটি ইনস্টলেশনেই স্পষ্ট।

মণ্ডপসজ্জায় কারুকলার জয়যাত্রা

এই বছরের মণ্ডপ নির্মাণে কারিগর ও শিল্পীদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। তাঁরা শুধু থিম তুলে ধরেননি, বরং নৃত্যকলার সৌন্দর্যকে স্থাপত্যে রূপ দিয়েছেন। কাঠ, মাটি, ফাইবার, কাপড়সহ নানা উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে নানান ভঙ্গিমা, যা দর্শনার্থীদের চোখ আটকে দিচ্ছে।

আলোকসজ্জার পরিকল্পনা আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে মণ্ডপের আবহ—নৃত্যমুদ্রার ওপর বিশেষ আলো, রঙের গ্রেডেশন, আর সুরেলা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক পুরো থিমকে তৈরি করেছে এক জীবন্ত সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা।

রোজ সন্ধ্যায় লাইভ নৃত্যানুষ্ঠান

কুন্ডগলী নটরাজের বিশেষ আকর্ষণ হলো—লাইভ নৃত্য পরিবেশনা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নদীয়া, হুগলি, কলকাতা ও দক্ষিণ ভারত থেকে আগত ভরতনাট্যম ও কথাকলি শিল্পীরা মঞ্চে পরিবেশন করছেন মনোমুগ্ধকর নৃত্য। শিল্পীদের অভিব্যক্তি, শারীরিক ভঙ্গিমা ও সাজসজ্জা দর্শকদের মুগ্ধ করে তুলছে, অনেকেই মোবাইলে ভিডিও করে এই অনবদ্য অভিজ্ঞতার স্মৃতি ধরে রাখছেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, “এত মানসম্পন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কার্তিক পূজায় আগে দেখিনি। যেন মেলা নয়, এক সাংস্কৃতিক উৎসব!”

৭২ বছরের ঐতিহ্যকে নতুন রূপ

এ বছর যেহেতু কুন্ডগলী নটরাজের ডায়মন্ড জুবিলি বর্ষ, তাই মণ্ডপে বিশেষভাবে প্রদর্শিত হয়েছে পুরনো স্মৃতি, প্রথম পূজার ছবি, প্রাক্তন সদস্যদের অবদান, ক্লাবের বহু বছরের সাফল্য ও সমাজসেবার নজির। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরার পাশাপাশি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাকেও এ বছর গুরুত্ব দিয়েছে ক্লাব।

ভিড় সামলাতে প্রস্তুত প্রশাসন

পূজা উপলক্ষে দর্শনার্থীদের ভিড় প্রতিদিনই বাড়ছে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা, পুলিশ পিকেটিং, স্বেচ্ছাসেবকদের দল—সব মিলিয়ে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা হচ্ছে। বিকেল থেকেই মানুষের ঢল নামছে, বিশেষত লাইভ নৃত্যানুষ্ঠান শুরু হওয়ার সময়।

সংস্কৃতি ও পূজা—এক অনন্য মেলবন্ধন

কুন্ডগলী নটরাজ এ বছর প্রমাণ করেছে, পূজা শুধু উৎসব বা আনন্দের মেলবন্ধন নয়—সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও সমাজকে শিক্ষিত করারও মাধ্যম। ‘প্রবাহিনী’ থিমের মাধ্যমে ভারতীয় নৃত্যকলার যাত্রাপথ তুলে ধরা সত্যিই প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

https://youtu.be/B54cwQp87fA

সব মিলিয়ে, বাঁশবেড়িয়ার কুন্ডগলী নটরাজের ৭২ তম বর্ষের কার্তিক পূজা এ বছর নিঃসন্দেহে জেলার অন্যতম আলোচিত, সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় পূজাগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠেছে।